শুকনা জমিতে পাট জাগ দেওয়ার পদ্ধতি

শুভদিন অনলাইন রিপোটার:

গুণগতমানসম্পন্ন পাটের আঁশ পেতে হলে পানিতে পাট জাগ দিতে হয়, এটাই চিরাচরিত পদ্ধতি। তবে সবচেয়ে ভালো মানের আঁশ পাওয়া যায় যদি প্রবহমান পানিতে জাগ দেওয়া হয়। পানির প্রবাহের গতি হবে প্রতি ঘণ্টায় এক-চর্তুথাংশ মাইলের বেশি। বদ্ধ পানিতে পাট জাগ দিলে আঁশ কালো হয়ে যায়।
কারণ পাটগাছে আছে ট্যানিন (tannin) এবং মাটিতে থাকে লোহা। ট্যানিন ও লোহার মিশ্রণ হলে কালো রং সৃষ্টি হয়। সে জন্য বঁটি দিয়ে কাঁচা আম, পেয়ারা, কাঁচকলা ইত্যাদি কাটলে বটিতে কালো দাগ পড়ে।
যখন বর্ষা মৌসুমে পাট কাটা হয়, তখন জমিতে বা ডোবায় পানি থাকার কথা, যেখানে পাট চাষিরা পাট জাগ দিয়ে থাকেন। কিন্তু আবহাওয়ার পরিবর্তনে কয়েক বছর ধরে পানির সংকট। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়াই এই বিপত্তির কারণ। সে কারণে সর্বত্র কৃষকরা ভালো মানের পাটের আঁশ পাচ্ছেন না।
এই পাট জাগ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট ‘রিবন রেটিং’ (Ribbon Retting) পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এই প্রযুক্তি কৃষকদের মাঝে সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক সহায়তা ও প্রযুক্তি জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তিটি যতটা অনুসরণ হবে, আশা করা হয়েছিল বাস্তবে ততটা ব্যাপকভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না।
এই পদ্ধতিতে পাটগাছের গোড়া থেঁতলিয়ে একটা Y আকারের লোহার ফালিতে রেখে পাটগাছের বাকলগুলো দুই হাতে ধরে নিজের দিকে টেনে আনতে হয় এবং পাটকাঠি সামনের দিকে চলে যায়। পরে এই পাটগাছের বাকলগুলো আঁটি বেঁধে কৃত্রিমভাবে তৈরি ডোবায় পানি ভরে জাগ দেওয়া হয়।
যথাসময়ে এই জাগ দেওয়া পাট অন্যত্র ধুয়ে ফেলা হয়। জাগ দেওয়ার স্থানে বা আশপাশে পানি না থাকলে কৃষকরা সেই জাগ দেওয়া পাট দূরে নদীতে বা বিলে নিয়ে যান। এতে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। যেহেতু এই ডোবার পানি প্রবহমান নয়, তাই আঁশ কালো হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। এত কাজ করে তবু কিছু আঁশ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রযুক্তিটি অনেক কৃষক ঝামেলাযুক্ত মনে করেন। বিশেষত পাটকাঠি থেকে বাকল আলাদা করতে গিয়ে অনেকের হাত কেটে যায়। এ অবস্থায় কৃষকরা কিছুটা কম ঝামেলাযুক্ত প্রযুক্তি আশা করেন।
এই লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে বাস্তবায়িত CSISA (Cereal System Initiative for South Asia) প্রকল্পের কার্যক্রমের আওতায় ১০ বছর আগে শুকনা জমিতে পাট জাগ দেওয়ার পদ্ধতি পরীক্ষা করা হয়। ওই সময় আমি IRRI-র সঙ্গে যুক্ত থাকায় কিশোরগঞ্জে এবং টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে স্বল্প পরিসরে পরীক্ষা করার সুযোগ পেয়েছিলাম।
এটা কোনো কঠিন পদ্ধতি নয়। প্রথমে জমিতে একটি পলিথিন শিট বিছিয়ে নিতে হবে। তার ওপর পাটের আঁটিগুলো আড়াআড়িভাবে বিছিয়ে দিতে হবে, যেমন—গতানুগতিক পদ্ধতিতে পাট জাগ দিতে হয়। তার ওপর পাটগাছের আঁটিগুলো স্তূপ করে রাখতে হবে। এই স্তূপের চারদিক এবং ওপরের দিক লতাপাতা, চটের ছালা, কচুরিপানা ইত্যাদি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে, যাতে পাটগাছের গায়ে রোদ না লাগে। কোনো গাছের ছায়ায় এই জাগ দিতে পারলে আরো ভালো হয়। এই স্তূপটি ভূমি থেকে তিন ফুটের বেশি উঁচু না হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এই স্তূপ করার পর যে কাজটি নিয়মিত করতে হবে, তা হলো কোনো ডোবার পচা পানি বালতিতে করে স্তূপের ওপর ঢেলে দিতে হবে। ওই ডোবার পানিতে আগে কেউ পাট জাগ দিয়ে থাকলে আরো ভালো হয়। তাতে পানিতে পর্যাপ্ত ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যাবে, যা পাট পচাতে মূল ভূমিকা পালন করবে। বালতি দিয়ে ওই পাটের স্তূপে অতটুকু পানি ঢালতে হবে, যাতে পানি নিচের দিকে চুইয়ে যেতে যেতে পাটগাছগুলোকে ভিজিয়ে দেয় (অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়) এবং নিচে পলিথিনের ওপর কিছু পানি জমা হয়। এভাবে পানি না দিলে পাটগাছগুলো ভালোভাবে ভিজবে না এবং পচন অসম্পূর্ণ হবে। পলিথিন শিটে কিছু পানি জমে থাকলে ওপরের পাটগুলো সব সময় ভিজা থাকবে, যা ব্যাকটেরিয়ার বেঁচে থাকার জন্য সহায়ক হবে এবং পচনপ্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
এভাবে দৈনিক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত পানি ঢালতে হবে। এভাবে প্রায় দুই সপ্তাহে যথারীতি পচনপ্রক্রিয়া সমাপ্ত হবে। তবে মাঝে মাঝে দু-একটা গাছ টেনে বের করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে পচনপ্রক্রিয়া কী পর্যায়ে আছে।
যখন বোঝা যাবে যে পাট জাগ হয়ে গেছে এবং ধোয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে, তখন এক বালতি পানিতে (১০ লিটার) ১০০ গ্রাম ফিটকিরি গুলিয়ে স্তূপের ওপর ঢেলে দিতে হবে। এই ফিটকিরি মিশ্রিত পানিও ততটা দিতে হবে, যাতে তা চুইয়ে চুইয়ে পলিথিন শিট অর্থাৎ স্তূপের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছায়। ফিটকিরি দেওয়ার ফলে পাটের আঁশের ময়লা আলগা হয়ে যাবে এবং আঁশের রং সাদা হবে।
এরপর জমিতেই পাটের আঁশগুলো পাটকাঠি থেকে আলাদা করতে হবে এবং শুধু আঁশগুলোই ধোয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য অন্যত্র জলাশয়ে নিতে পরিবহন খরচ লাগবে ঠিকই, কিন্তু পাটকাঠি পরিবহন খরচ সাশ্রয় হবে। বর্তমানে কৃষকরা পাট কাটার পর সেগুলো ভ্যানগাড়ি বা ট্রলিতে দূরের জলাশয়ে নেন এবং তাতে পরিবহন খরচ অনেক বেশি হয়।
পদ্ধতিটি বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে এবং অভিজ্ঞতার আলোকে এর উৎকর্ষ সাধন করা যেতে পারে।
এখানে একটি প্রাকৃতিক বিষয় উল্লেখ করা যায়, যা পচনপ্রক্রিয়ায় প্রাসঙ্গিক। সর্বত্র দেখা যায় যে কলাবাগান ও পেঁপেবাগানের আশপাশে কলাগাছ ও পেঁপেগাছ ফেলে রাখা হয়, তা আপনা-আপনি পচে যায় এবং আঁশগুলো পচতে অনেক সময় লাগে। ফিলিপাইনে এই কলাগাছের আঁশ দিয়ে কাপড় তৈরি করা হয়, যা বেশ দামি। কলাগাছ ও পেঁপেগাছগুলো পচতে ব্যাকটেরিয়ার ভূমিকা আছে। এই ধারণা থেকেই এ গবেষণার শুরু।
এই ব্যাকটেরিয়া পাটগাছ পচনপ্রক্রিয়ায় কী ভূমিকা পালন করে, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট পরীক্ষা করে দেখতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়ার বংশ কৃত্রিম উপায়ে বৃদ্ধি করে তা দিয়ে পানিসংকটের সময় পাট জাগের কাজ করা যায় কি না তা-ও পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। এতে আঁশের গুণগত মানের উন্নতিকল্পে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণের দ্বার উন্মুক্ত হবে। -কালের কণ্ঠ

লেখক : ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস; সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল; সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট

Related posts

Leave a Comment